চড়ুই পাখির নকশা!

খুব ছোট বেলায় যখন আমরা দুইরুমের একটা বাসায় থাকতাম, আমাদের ছোট কিচেনটার ভেন্টিলেটারে দুইটা চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছিল। আমাদের বাসাটা ছিল অন্ধকার, চারিদিকে বড় বড় বিল্ডিং’র ভীড়ে আমাদের ছোট বাসাটাকে খুঁজে পেত না সূর্যের আলো। কিন্তু ঐ ভেন্টিলেটর ভেদ করে পড়ন্ত বিকেলে কীভাবে যেন ফাঁকফোঁক দিয়ে এসে ঢুকতো একটুকরো রশ্মি। ভেন্টিলেটরের চারটা পাখার ফাঁক দিয়ে আসা রশ্মি অদ্ভূদ এক নকশা তৈরী করতো কিচেনের মেঝেতে। তারমধ্যে যখন চড়ুই পাখি দুইটা উড়াউড়ি করতো, আমি ভীষন ভাল লাগায় যেন আরেক জগতে চলে যেতাম। পুতুল খেলতেও ভুলে যেতাম চড়ুই পাখি আর সূর্যরশ্মির আলো-আঁধারির নকশা দেখতে দেখতে।

তখন সব ভাই-বোন মিলে আমরা একটা খেলা খেলতাম। সবার হাত মাটিয়ে বিছিয়ে একজন কিল দিতে দিতে ছড়া বলতে থাকবে। ছড়াটার শেষ শব্দ যার হাতের উপরে শেষ হবে, তার সেই হাত বাদ। অনেকগুলো ছড়ার মধ্যে একটা ছড়া আমার খুব প্রিয় ছিল। …চড়ুই পাখি বারটা/
ডিম পেরেছে তেরটা/
একটা ডিম নষ্ট/
চড়ুই পাখির কষ্ট!
আমার খুব অবাক লাগতো! এতগুলো ডিম থেকে একটা ডিম নষ্ট হলে কী-বা আসে যায়?আম্মু বলতো- তোমার বাকী চারভাইবোন থেকে একজন চলে গেলে তোমার কেমন লাগবে? আমি তাও বুঝতাম না।
তারপর একদিন হঠাত করে ‘নজিনি’ (ওকে দুষ্টুমী করে আমরা এই চাইনিজ নামে ডাকতাম!) মরে গেল! একদম বিনা নোটিশে…
আমি প্রথম বুঝলাম চড়ুই পাখির যত ডিম-ই থাকুক, একটা ডিমও যদি নষ্ট হয়, তাহলে তার বুকটাও ঠিক এভাবেই টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

ইসলামাবাদে যখন প্রথম ঈদ ভেকেশানে ফরেনার স্টুডেন্ট ছাড়া আর সবাই চলে গেছে যার যার বাড়িতে, গ্রুপ-ট্রাভেলেও বেরুতে ইচ্ছা করছিলনা বলে একলা থেকে গেছি হল-ওয়ানের থার্ড ফ্লোরে… আমার ফ্লোরের একদম শেষপ্রান্তে শুধু একটা কেনিয়ান মেয়ে আছে; তখনো দিনের সবচে বড় সময় চলে যেত হল-ওয়ান গার্ডেনে চড়ুই পাখিদের উড়াউড়ি দেখে।
কেনিয়ান মেয়েটা অবাক হয়ে যেত। আমার সাথে বসত। তারপর একসময় ধৈর্য্য হারিয়ে উঠে যেত। আমার কেন যেন সূর্যের আলোয় ফুল আর চড়ুইদের খেলা দেখতে কিছুতেই বিরক্তি লাগতোনা। এক একসময় ঘাসের উপর শুয়ে যেতাম ক্লান্ত হয়ে। তাও রুমে ফিরতে মন চাইতোনা। চড়ুই দেখতে দেখতে, আকাশ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যেতাম ঘাসের উপরেই।
কেনিয়ান ওর নাম ছিল- ট্যাটু।
জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘ট্যাটু’ অর্থ কী?
বলল- আমাদের লোকাল ভাষায় এর অর্থ-‘তিন’।
-তিন?!
- হ্যা। আরবীতে যেমন চারনাম্বার বাচ্চা মেয়ে হলে নাম রাখে ‘রাবিয়া’(চার), ওরকম আমাদের ওখানেও তিন নাম্বার মেয়ে হলে নাম রাখে ‘ট্যাটু’।
-এক-কে কী বল?
-মোজা।
-মোজা?!! তুমি জানো আমাদের ভাষায় মোজা কাকে বলে?!
-কাকে?
-সকস্ কে!
-হাহাহাহাহাহা!
-আর দুই?
-বিলি।
আমি তখন ওকে তিনটা চড়ুই পাখি দেখিয়ে হাতের আঙ্গুল দিয়ে গুনে গুনে দেখাই- হেয়ার ইস মোজা, দ্যাটস বিলি এন্ড হেয়ার ইস ট্যাটু!!
ও হাসতে হাসতে লনের সিড়ি থেকে বলতে গেলে গড়িয়ে পড়ে যায়!

ছোট থাকতে ক্লাসে যখন পড়ালো আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল; আমি অবাক হয়ে বইয়ের ছবি দেখতাম। দেখতে খারাপ লাগতো না। কিন্তু কেন যেন মনটা পড়ে থাকতো চড়ুই পাখির কাছে। বইয়ে ছবি দেখলেও আমি দোয়েল পাখি চিনতাম না অনেক বড় হয়েও! মাত্র ক’বছর আগে প্রথম দোয়েল পাখি চিনেছি আমার ফুপাতো বোনের কাছে। আমাদের বাড়ির পুকুরের পাশের গাছে বসে ছিল। দেখে ভীষন অবাক হয়ে ভেবেছি- ধুর! এটা একটা জাতীয় পাখি হল?! তারচে’ চড়ুই পাখি হাজারগুনে সুন্দর!

এরপর যাযাবরের মত নিজের থাকার জায়গা বার বার চেইঞ্জ হতে থাকায় চড়ূই পাখিদের হারিয়ে ফেলি নাগরিক ব্যাস্ততায়। অনেক অনেক দিন পর, সেদিন পরীক্ষার পড়া পড়ছিলাম।পড়তে পড়তে আকাশ দেখা আমার প্রিয় অভ্যাস।জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি, হঠাত খেয়াল হল, একি!! এসির খোপ থেকে একটা জলজ্যান্ত চড়ুই পাখি বের হচ্ছে!! আমি হা করে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখি আরেকটা!!
দ্রুত উঠে জানালার শাটার খুলে দেখি- আরে তাইতো!!
এসির খোপের ভিতর চড়ুই পাখির বাসা!

নীচেই রাস্তা থাকায় আমি সাধারনত শাটার খুলিনা।গাড়ির আওয়াজ আমার ভালো লাগেনা। কিন্তু এখন, প্রতিদিন ভোরে শাটার খুলে চুপ করে চেয়ারে বসে থাকি। সকাল বেলা এই দুইটা চড়ুই যেন ভীষন ব্যাস্ত থাকে। এই বের হয়, এই ঢুকে, একটা আরেকটার সাথে চিউক চিউক করে কী যেন বলে; যেন দু’জনে মিলে সারাদিনের প্ল্যান ঠিক করে। সূর্যটা ভালো করে উঠতে শুরু করলেই দু’জনে চলে যায় খালি বাসা ফেলে।
আমি যেন সারাদিন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে পাহারা দেই ওদের ছোট্ট বাসাটা!
তারপর আবার যখন ওরা ফিরে আসে সন্ধ্যায়, আস্তে আস্তে উঁকি দিয়ে দেখে নেই- ওরা দু’জন ভালই আছে। এখনো ওদের দু’জনের চিউক চিউক শুনতে শুনতে লিখছি আর ভাবছি- পড়ার টেবিলের জানালার পাশে চড়ুই পাখি থাকা মন্দ না! :) B-)

Comments

  1. সেই চড়ুই পাখি দু'টো কি এখনো আছে আপ্পি ???? তাদের বাসা কি এখনো পাহারা দেন ???

    আমার সবচাইতে ভালো লাগে চড়ুই পাখির সাহস। সাইজে ছোট হলে কি হবে ?? ভীষণ সাহসী পাখি এই চড়ুই !!!

    আরররর, আপ্পি কি ছোটবেলার কিছু ক্লাস ইসলামাবাদে পার করেছিলেন নাকি ????

    ReplyDelete

Post a Comment