একদিন আমি আর কমলাফুলি ঠিক বের হবো

-
আমাদের বন্ধু সার্কেলে এখন একমাত্র জীবিত ব্যক্তি একজনই আছে। ইয়ে সে জীবিত তার মানে এই না যে আমরা বাকীরা সব মৃতনচিকেতার ভাষায় আমরা জীবিতও না, মৃতও না, আমরা বিবাহিত!! তো জীবিত এই মানুষটারও এখন বিয়ের কথাবার্তার ঘন্টা বাঁজছে। বাঁজতে বাঁজতে চললো ঢুলি/ঢুলি গেলো কমলাফুলিধরে নিন এই জীবিতজনের নাম কমলাফুলি।
 তো কমলাফুলির সাথে আমার নিম্নোক্ত কথোপকথন-
আমিঃ দোস্ত, তুই-ও শেষ পর্যন্ত কোরবান হইতে চললি?
কফুঃ শ্লা, কথা কইশ না, মাথা বললাম গরম কিন্তু।
: হে হে, আমি কোরবানীর ধারালো ছুরিটা দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, আল্লাহু আকবার!
: তোরে বললাম না মাথা গরম, ঠাট্টা করবিনা?
: আচ্ছা, কাহিনী কী দোস্ত? তুই না বলে জীবনেও বিয়া করবিনা? তোর বাপকেও তো পট্টান দিছিলি ভালই। এমন বাপ পুরা দুনিয়াতে আরেকটা পাওয়া মুশকিল। তোর কপালরে শালা।
:, সমাজে শুধু যদি বাপজান থাকতো তাইলে তো আর সমস্যা ছিলো না।
: তুই আবার সমাজ মানা শুরু করলি কখন থেকে??? (এইখানে আমার চোখ-মুখ বিষ্ময়ে পাল্টি খাওয়ার ইমো হবে!)
:' আমি কখন থেকে সমাজ মানি সে প্রশ্ন না করে আপনারা সবগুলা মিলে যে আমাকে এতিমের মত ছাইড়ে দিয়ে নিজেরা যার যার মত ঠিকই ঘর সংসার শুরু করলেন সেই কাহিনী কে বলবে??
: তুই তো ডিফরেন্ট।
: গুল্লি মার ডিফরেন্টগিরীর!

কফু আই মিন কমলাফুলির বিয়ে হবে। আর সেই খবরে আমি উদাসীন। না, না, এখনো বিয়ের পাত্রই ঠিক হয়নি, কিন্তু ঐ যে ও ঠিক করেছে ও বিয়ে করবে- সেই খবরেই! প্রাণের দোস্ত বিয়ে করবে, খুশীতে ডুগডুগি বাজানো উচিত, অন্যদের মত 'দোস্ত তোর বিয়েতে আমি কিন্তু এই শাড়ী পড়ুম!' 'ঐ ছেমড়ি বিয়ার ডেইট কিন্তু এই সময়ে ফেলবি না!' 'তোর মত দস্যি মেয়ে বিয়ে করবে, বললেই হলো, কবুল না বলা পর্যন্ত বিশ্বাস নাই'-- ইত্যাদি ইত্যাদি আলোচনায় অংশ নিতে পারা উচিত, আমার বিয়ের আগে সব বিবাহিত বন্ধু-মহল যেমন একেকজন একেকটা 'বিজ্ঞ' পরামর্শ দিয়েছিলেন সেইরকম আমারো কোনো একটা বিজ্ঞ পরামর্শ দেয়া উচিত, কিন্তু সব 'উচিত'কে পাশ কাটিয়ে আমি উদাসীন। তাই আবার কফু, আই মিনি কমলাফুলির দারস্থ-

আমিঃ দোস্ত, তুই বিয়া করবি এই সিদ্ধান্তে মন ভালো না।
কফুঃ ক্যা?? তুই-ই তো আমাকে বিয়া করাইতে উঠে পড়ে লাগছিলি।
: হে হে, বুঝশ নাই? আমরা সব বিবাহিত, তুই জীবিত, তাই একমাত্র জীবিত-জনের প্রতি ঈর্ষা!
: ছি! তুই এত্ত খারাপ?
: এতদিনে বুঝলি?
: হুম। দোস্ত, ' দেখি, তোকে বৈরাগ ধরছে ক্যান?
: আগের দিনে ব্যাক করতে মন চায়।
: কোন দিনে?
: ঐ যে তুই, আমি, পদ্মা আর শাপলা (এই দুইটাও কমলাফুলির মত ধার করা নাম!!) মিলে নেভালে গিয়ে সিমেন্টে পা ঝুলায়ে বসে জাহাজের ভেঁপুর সাথে সাথে গলা ফাটায়ে চিৎকার করার দিনে।
: মর শালা! এইটা কঠিন কী? তুই দেশে আয়, যাবোনে একদিন। আবার দুইজনে গলা ফাটায়ে ফেলবো জাহাজের সাথে পাল্লা দিয়ে! শাপলাকে অবশ্য পাওয়া যাবেনা মনে হয়। শালা গেছেগা ঢাকা। পদ্মাকে পাইতেও পারি নাও পাইতে পারি। নো প্রোবলেমো, আমরা দুই দোস্ততো আছি।
: হুম। আর মনের ভিতর যে ইটিশ পিটিশ ফুলকি'র দিন?
: সেটা কী?
: ঐ যে, একটু একটু প্রেম প্রেম ভাব, কিন্তু প্রেমের অভাব!
: হা হা হা হা, দুঃখিত দোস্ত, ঐ সব দিন ফেরত আনা যাবেনা।
: ক্যান?
: ইয়ে, রিস্কি হয়ে যাবে!
দুইজনেই হাসতে শুরু করি। হাসতে হাসতে আমার কাঁশি উঠে যায়। সিডনীতে মাত্র উইন্টার গেলো, সামার আসছে। এটা দুইনাম্বার উইন্টার, ঠান্ডাটায় কিছুটা হলেও অভ্যস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু অভ্যস্থ হতে পারি নাই। অনেকটা জীবনের সাথে অভ্যস্থ না হয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়ার মত।  

-
এতটুকু লিখার পর একটু থেমে লিখাটা নিজেই পড়লাম। পড়ে মনে হলো এটা কী লিখেছি? এই লেখা ব্লগে দিলে শিরীনের কাছ থেকে আরেকটা গালি খেতে হবে। লাষ্টবার ও থ্রেট দিছে "তোর লেখা আর পড়ুম না"। জিজ্ঞেস করছিলাম, 'কেনো?' ওর সোজা কথা, "আরে সাধারণ কথাও এমনভাবে লিখশ পড়লেই মন খারাপ হয়ে যায়। ধর আমি বললামআজকে বিকেলে আমি হাঁটতে হাঁটতে স্টেশানে গেছি ট্রেন ধরতে। কিন্তু এই সেইম লাইনটাই তুই ঘুরায়ে প্যাচায়ে এমনভাবে লিখশ, পড়ে মনে হবে, আহা বিকেলবেলা হাঁটতে হাঁটতে স্টেশানে ট্রেন ধরতে যাওয়া পৃথিবীর অন্যতম দুখখের কাজ!"
হাসতে গিয়েও হাসতে পারি নাই। আমি কী তাহলে একটু দুঃখবাদী?
শিরীন বোয়াল মাছের মত ঘাঁই মেরে উঠেছিলো, 'দুঃখবাদীই শুধু না, চরম দুঃখ-বিলাসী-বাদী'!!
ওর এই কথার পর আর কী লিখতে ইচ্ছে করে বলেন?

-
আচ্ছা, আমরা আবার কমলাফুলির কাছে ফেরত আসি।
কমলাফুলি, আমি, পদ্মা, শাপলা আমরা সমাজের আর দশটা মেয়ের মত। আমাদের অনেক ছোটখাটো না-বলা, না-জানা দুঃখ, কষ্ট আছে। কিন্তু তারপরও আমরা সুখী। কারণ আমাদের বড় কোনো সমস্যা নেই। যা আছে, তাকে কফু'র ভাষায় বলা যায়, 'আমাদের সমস্যা না, এইগুলা হলো মডার্নিটীর সমস্যা বুঝলি দোস্ত। আগের কালের মত যদি দেখতি গোত্রে গোত্রে বসবাস করতাম, বেঁচে থাকার বেসিক জিনিষ যেমন ধর, পানি, খাবার আর কাপড় জোগাড় করতেই দিন চলে যাইতো, তাইলে দেখতি রাতের বেলা আগুন জ্বালায়ে সেই আগুনের চারপাশে বসে আমরাও সুখী মানুষের মত গোত্রের ওল্ড ম্যান বা উইম্যানের কাছ থেকে কাহিনী শুনতাম। আমরাও দেখতি একটা সাউন্ড স্লিপ দিয়ে ভোর বেলা উঠে আবার সেই বেসিক জিনিষের সংগ্রাম করে যেতামএখন সমস্যা কই জানস? আমাদের সবকিছু এত বেশী বেশী, বেসিক জিনিষের এপ্রিসিয়েশানটা তাই আর নাই। তাই দেখ, জীবনের মত এমন মহামূল্যবান জিনিষটাকেও তুচ্ছ ধরে নিয়ে ঠুশ করে আত্নহত্যা করে ফেলি। তুই-ই বল, এই মডার্ণ সময়ে যত মানুষ-পোলাপাইন-বুড়াবুড়ি আত্নহত্যা করে, হিষ্ট্রী-তে কোথাও পড়ছশ এইরকম হারে মানুষজন আত্নহত্যা করতো?'
আমি আর্গু করতে চেষ্টা করি 'তখন মানুষের সংখ্যাও তো কম ছিলো' বলে। কিন্তু ও আমাকে তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়, 'তোর মত ঐসব পোষ্টগ্র্যাড হাবি জাবি পড়ালেখা করলে এই সমস্যা, খালি তর্ক করশ, আমি বললাম এইসব মডার্নীটির সমস্যা!'

তর্ক করি- এই অভিযোগের পর আপাততঃ আর তর্ক চলেনা। হ্যা, যা বলছিলাম, 'মডার্নীটির(!!) সমস্যা বাদ দিলে আমরা সুখী। তারপরও আমরা মাঝে মাঝেই কেমন যেনো অস্থির হয়ে উঠি। মন চায়, কোথাও যাই কোথাও যাই। অনেক দূরে কোথাও যেন একটা পাখি ডাকে। যতক্ষন উঠবোনা, যতক্ষন নড়বোনা এই এক বৃত্তের ভিতর থেকে, ততক্ষন যেনো পাখিটা ডেকেই যাবে। কোনো এক ঘুমভাংগা ভোরে আমরা ক্ষণিকের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে যেই, একী! এ সংসারের কাউকেই যে আমরা চিনিনাসেই বিভ্রান্তি অনেক অনেকদিন পর বার বার ফিরে আসে। আমরা তখন শূণ্য চোখে খুঁজতে থাকি- কী হারালো গো? কী যে হারালো!

এমন কথা কখনো শুনেছেন? কী হারিয়েছে তা না জেনেই শুধু অনুভব করা যেনো কিছু একটা হারিয়েছে। সেই হারানো বোধ আবার মনের ভিতর কুট কুট করে কষ্ট দেয়। তখন খালি মনে হয়, এই ঘর এই দুয়ার এইসব কিছুর কিছুই আমার না। যা আমার, তা অনেক দূরে, যেখানে যেতে হবে। দূরের পাখিটা সেখানে যাওয়ার জন্যই অবিরাম ডেকে যাচ্ছে

-
কমলাফুলির সাথে আমার প্ল্যান ছিলো- পদ্মা, শাপলাকে দিয়ে হবেনা, শুধু আমরা দু'জনে বের হবো। দেশটাকে একটু দেখবো। কুয়াকাটা যাবো। নীলগিরী যাবো। গ্রামে গ্রামে যাবো। কিন্তু এত খরচের টাকা পাবো কোথায়? আমাদের তখনকার নিষ্পাপ প্ল্যান, 'শোন দুইজনেই বিয়া করলে বিয়াতে স্বর্ণ পাবো না? সেই স্বর্ণ বেচে দিয়ে বের হবো'! - খোদা কী তখন উপর থেকে আমাদের কথা শুনে হেসেছিলেন? হিহিহি, ওয়ান অব দ্য বেষ্ট জোক্স এভার, হাসারই কথা।

আমার ছোটভাই একবার বললো, 'আমি আর আব্দুল যাচ্ছি, তুমি যাবা?'
আমি খেঁক করে উঠেছিলাম, 'তোরা দুইটা ছেলে। ওখানে আমি একলা একটা মেয়ে। আমাকে নিয়ে পরে তোরা বিপদে পড়বি। আর আব্বুম্মু যাইতে দিবে মনে করছোস?'
ছোটভাই আম্মু থেকে জোড় করে দুইশ' টাকা নিয়ে উধাও। দশ-পনেরদিন পরে যখন ফিরলো, চাঁদ মুখটা রোদে-টোদে কালচে হয়ে গেলেও, জামা-কাপড়ের অবস্থা দেখার মত জঘন্য হলেও, তার গল্প দেখি ফুরায় না। মাত্র দুইশ টাকা দিয়ে যে এত জায়গায় ঘুরা যায়, সে বিশ্বাস করতে মন চাইছিলো না। কিন্তু জানলাম, দুইজনে কখনো কখনো ঘুমাইছে স্টেশানে। আবার অনেকসময় অনেক অচেনা বাড়িতে খাবার খাইছে। শহরের মানুষ দেখলে গ্রামের মানুষগুলা এখনো সহজ সরল আনন্দে পান্তাভাত আর মরিচের সাথে একটু আলাদা খাতির করে একটা ডিম ভেজে দেয়। অচেনা হলেও বাড়ির তুলে রাখা মাদুরটা এনে পেতে দেয়।

ও প্রায়ই উধাও হয়ে যেতো। পড়ালেখা চাংগের আগায়। আম্মুর টেনশান। আব্বু যথারীতি নিরব। আমি বড়বোন সুলভ রাগ, ধমকাধমকি, 'তুই ইন্টারও যদি পাশ না করশ, বউ-বাচ্চাকে খাওয়াবি তো দূরের কথা, তুই নিজে খাবি কী?' 'দেখ, এখন যারা তোকে তেল মারতেছে, আল্লাহ না করুক- আব্বুম্মু না থাকলে তোর দিকে ফিরেও তাকাবেনা। শুধু শুধু নিজের জীবন বরবাদ করতেছশ'। এই সেই- ধমকের শেষ নাই। কিন্তু হঠাৎ-ই একদিন টের পেলাম- যতই টেনশান করি, যতই ধমকাই, আমি আসলে এই ছোটভাইটাকে ঈর্ষাই করি। কী সুন্দর একশ' টাকা পকেটে নিয়ে সে এক কাপড়ে বের হয়ে যায় তার এই আব্দুল নামের বন্ধুর সাথে। কোথায় কোথায় যায় নায় সে? যেদিন বুঝলাম আমি ছেলে হলে হয়তো আমিও সেইম এই কাজগুলাই করতাম, সেদিন থেকে ধমকানো বন্ধ। আমরা ভবিষ্যত'র জন্য উদ্বিগ্ন হই, কিন্তু আদৌ কি সেই ভবিষ্যত আসবে কিনা তা কী জানি? যা নিশ্চিত না, তাই নিয়ে টেনশানের কী আছে। তারচে' চলুক না যেমন চলছে। সেই ছোটভাই এখন মাঝে মাঝে খোঁচায়, 'আপু, তুমি না বলছিলা ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বের হবা?'

ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার এই আদিম বাসনাটা ক্যান্সারের মত। চিকিৎসার পর ভাল হয়ে যায়, তারপর অনেকদিন পর আবার দেখা যায় আসলে ভাল হয়নি, কোষের ভিতর কোনো এক কোণায় লুকিয়ে ছিলো। কমলাফুলি আর আমি সেই ক্যান্সার-আক্রান্ত! কমলাফুলি'র এখন বিয়ে হবে, তাই সে আপাততঃ খুব অদ্ভূদ সব অনুভূতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে- রাগ, হতাশা, আনন্দ, উৎকন্ঠা, কেমন যেন সব হারানোর অথচ আবার সব পেয়ে যাওয়ার অনুভূতি- সব অনুভূতিই এখন তার চরম মাত্রায় কমলাফুলিকে ঘিরে। ছোটবেলার ছড়া মনে পড়ে, আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাঁজে/ ঢাক ঢোল ঝাঁজর বাঁজে…  ঢুলি এসে কমলাফুলিকে নিয়ে যাবে। সাঁনাই বাজবে, বর আসবে, লাজুক বউ হয়ে কমলাফুলি চোরা চোখে বর দেখবে। 

তারপর।
তারপর অনেক অনেকদিন পরে আমি হয়তো আরেকটা লেখা লিখবো, কমলাফুলির বিয়ের পরও আমাদের কথোপকথন নিয়ে; কীভাবে আমরা তখনো প্ল্যান করি বিয়ের স্বর্ণ বেঁচে দিয়ে আমি আর কমলাফুলি পৃথিবী দেখতে বের হবো ভেবে।

Comments

  1. আপু, অনেক বড় লিখেছো। একটু ছোট ছোট করে লিখবে। ছোট লেখা পড়তে ভালো লাগে।

    ReplyDelete

Post a Comment