ঢাকা শহরে একদিন আমি একদিনের জন্য একটা এম্বুলেন্স ভাড়া নিবো
ইদানিং
আমার দিন কাটছে ড্রাইভিং-এ ড্রাইভিং-এ। এবং টের পাচ্ছি কেনো যারা সবসময়
ড্রাইভ করে তারা সুযোগ পেলেই কেনো ড্রাইভ করতে চায়না। রেগুলার ড্রাইভ করতে
থাকলে ড্রাইভিং'র প্রথম দিকের উত্তেজনাটা দ্রুত কমে যায়, তারপর একসময় পুরো
বিষয়টাই বোরিং টাইপ হয়ে যায়।
মানুষের ব্রেইন অতীব ইন্টারেষ্টিং
একটা জিনিষ, ড্রাইভিং'র বোরিং-নেস কাটাতে গিয়ে আমার ব্রেইন একটা আইডিয়া বের
করেছে, কিছু কাছের মানুষকে আমার ব্রেইন কল্পনা করে নেয় গাড়ীতে আমার পাশের
সিটে বসে আছে। স্কিৎজোফ্রেনিক হয়ে যাচ্ছি নাকি আল্লাহই জানে! যেমন গতকাল
হঠাৎ-ই মনে হলো আব্বু আমার পাশের সিটে বসে আছে, আর একটু পর পর অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করছে, বুড়ি, গাড়ি চালাইতে শিখছো কার থেকে?
আব্বু, আপনাদের জামাইর কাছ থেকে।
খুব ভালো, খুব ভালো। অমুক দেশে দেখছিলাম প্রচুর মেয়ে গাড়ি চালায়।
আমি আড়চোখে দেখি আব্বুর চোখে মুখে খুশীর ছাপ, তার বড় মেয়ে তাকে গাড়ি
চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আব্বুর কি একটু প্রাউড প্রাউড লাগছে? বুঝা মুশকিল।
আব্বু ঐসব মানুষদের একজন যাদের মনের ভিতরে কী আছে তা বাইরে থেকে বুঝতে
চাওয়া প্রায় অসাধ্য একটা ব্যাপার।
আব্বু আবার জিজ্ঞেস করে, বুড়ি, গাড়ি চালাইতে শিখছো কখন?
আম্মু বলছিলো আব্বুর এই রোগটা হয়েছে, একই কথা বার বার জিজ্ঞেস করে।
কিন্তু আমি বিরক্ত হইনা। আমার ভাল লাগে। ইচ্ছে করেই একটু স্পীড বাড়াই। আব্বু হালকা নড়েচড়ে বসে।
গাড়ি চালাইতে কিন্তু সাবধান, একটুর থেকে একটু হলেই কিন্তু এক্সিডেন্ট হতে পারে। কখনো অমনোযোগী হবা না।
জ্বী আব্বু।
আব্বুকে নিয়ে আমার ইচ্ছে হয় গাড়ীর দুইদিকে দুইটা ডানা লাগাই, উড়ে উড়ে যাই।
আব্বু উড়ন্ত গাড়ি থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলবে, বুড়ি, দুনিয়া কত
আগায়ে গেছে দেখো, এখন আবার গাড়ি উড়তেও পারে, তোমার আম্মুকে একদিন এই গাড়িতে
নিয়ে বের হইয়ো।
আমি বলি, ঠিক আছে আব্বু, আম্মুর সাথে দাদীকেও এই গাড়ীতে চড়াবো।
আব্বু খুশী হয়। আমি স্পষ্ট আব্বুর চেহারায় সে খুশী দেখি।
একবার কোনো এক কারণে রেগে গিয়ে দাদীকে ভীষণ একটা কথা শুনিয়েছিলাম আব্বুর
সামনে। আমি রাইট ছিলাম, তাই আব্বু কিছু বলতে পারেন নি তখন। কিন্তু আব্বুর
চেহারা কালো হয়ে গিয়েছিলো। কী জানি আব্বু এখনো সেই ঘটনা মনে রেখেছেন কিনা।
মনে না রাখলেই ভালো, জীবনের খারাপ, কষ্টের ঘটনা যে যত তাড়াতাড়ি ভুলে যায় সে
তত আরামে থাকতে পারে।
আব্বুর মুডের সাথে গতি'র একটা সম্পর্ক
আছে। আব্বু এমনিতে খুম কম কথার মানুষ। এখনো যখন ফোন করি, 'তুমি কেমন আছো'
'নানু কেমন আছে' 'জামাই কেমন আছে' ব্যাস, তিনটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে
গেলেই বলে 'আচ্ছা রাখি'।
একটা সময় ছিলো, খালি তড়পাতাম একটু আব্বুর
সাথে কথা বলতে, আম্মুর সাথে কথা বলতে। কিন্তু আব্বুর সাথে কথা বলতে সাহস
পেতাম না। আর আম্মুর কাছে সময় পেতাম না। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো যখন আব্বুর
সাথে কোথাও যেতাম। বিশেষ করে আব্বুর সাথে ঢাকা-চট্রগ্রাম গাড়ির
জার্নিগুলোতে আব্বু অ-নে-ক কথা বলতো। গাড়ির গতির সাথে সাথে আব্বু তার জীবনে
কী দেখেছেন না দেখেছেন, কত কথাই যে বলতেন! আর আমার সামনে বাইরের না চেনা
না জানা একটা দুনিয়ার দরজা খুলে যেতো। আব্বুর কথার মধ্য দিয়ে আমি কোন দেশে
সাগরের পানির ভিতর দিয়ে টানেল গিয়েছে, কোন দেশে মানুষ কেমন, কোন দেশে কখন
কী হয়েছিলো সবকিছু দেখে নিতাম।
আমার গাড়ির গতির সাথে আব্বুর সেই
কথা বলা ফিরে আসে। কিন্তু সবই গাড়ি কেন্দ্রিক। আমি টের পাই, আব্বু আসলে
ভিতরে ভিতরে খুবই খুশী মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে আর তিনি বসে আছেন পাশে তাই।
বুড়ি, তুমি কি ভার্সিটিতে গাড়ি নিয়ে যাও?
গাড়ি চালাইতে কখনো দূর্ঘটনা হয় নাই তো?
দেখছো, এখানে এত গাড়ি কিন্তু সব কেমন লাইনে লাইনে চলতেছে, একটার সাথে আরেকটার সমস্যা নাই।
আমি মাঝখান থেকে বলি, আব্বু দেখছেন এখানে কিন্তু কোনো হর্ণের আওয়াজও নাই।
আব্বু অবাক হয়ে বলে, ঠিক!
গাড়ি চালাতে চালাতে আব্বুকে পাশের সিটে কল্পনার আপাততঃ এখানেই যতি টানি।
এমনটা না যে আমি দেশে গিয়ে গাড়ি একটা ভাড়া নিয়ে আব্বুকে পাশে বসায়ে গাড়ি
চালাতে পারিনা। পারি। চাইলেই একটা গাড়ি সারাদিনের জন্য ভাড়া নিয়ে আব্বু
আম্মু দাদু ছোটভাইবোন দু'টা, ফুপাতো বোনটা আর কাজের খালাম্মা সবাইকে নিয়ে
ঢাকা শহরে সারাদিন গাড়ি চালাতে পারি ভুশ ভুশ করে। সবাই উত্তেজনায় কী বলবে
না বলবে দিশা খুঁজে পাবেনা। ছোট ভাইটা বলবে, আপু, তুমি আমাকে দেখায়ে দিও তো
কয়েক দিন, মনে হচ্ছে ড্রাইভিং এত কঠিন না। ছোট বোনটা তখন তাকে পিঞ্চ করে
কোনো একটা ঠাট্টার কথা বলবে। গাড়ির সবাই হো হো করে হেসে উঠবে।
কিন্তু আব্বু গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে বিছানায় শোয়া। আগে তাও কিছুটা নড়তে
চড়তে পারতেন। এখন আর তাও পারেন না। বিছানার পাশে কলিং বেল, আম্মু রুম থেকে
একটু কোথাও গেলেই টিং টিং করে বার বার সেই কলিং বেল বাঁজাতে থাকেন। শুয়ে
শুয়েই ফোন করলে বড্ডার গলার আওয়াজ শুনলেই বলেন, নানুকে একটু দাও দেখি।
বড্ডাকে ফোন দিয়ে স্পীকারে দিলেই শুনি আব্বু গলা ছেড়ে হাঁক দিচ্ছেন,
না-আ-আ-আ-আ-আ-নু-উ-উ-উ!
বড্ডাও ডাকে, নানু!
আব্বু আরো জোড়ে হাঁক দেন, নানু নাকি!! নানু!! কেমন আছো তুমি?
আব্বু বসে থাকতে পারেন না।
ভাবছি, এতই যখন শখ, দেশে গিয়ে একদিন একটা এম্বুলেন্স ভাড়া নিবো।
এম্বুলেন্সে আব্বু শুয়ে থাকবে, আমি এম্বুলেন্স চালাবো। আব্বু শুয়ে শুয়ে
দেখবে তার মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। আর অবাক হয়ে একটু পর পর বলবে, বুড়ি, তুমি
গাড়ি চালানো শিখছো কখন?!
আচ্ছা, ঢাকা শহরে কী এম্বুলেন্স এইরকম ভাড়া পাওয়া যায়?
Comments
Post a Comment